পাখিরা কিভাবে নিখুঁতভাবে উড়ে যেতে পারে?

Date:

শেয়ারঃ

পাখিদের উড়ার বিষয়টি আমাদের কাছে সবসময়ই  চমকপ্রদ। আমরা প্রায়ই দেখি, একটি পাখি অনেক উচ্চতা থেকে উড়ছে, কখনো কোনো গাছ, তার, দেয়াল বা অন্য পাখির সাথে ধাক্কা লাগছে না। মনে হয় যেন তারা পৃথিবীর প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি গতি, এমনকি বাতাসের ধরণ পর্যন্ত জানে! তাহলে প্রশ্ন হলো – তারা এত নিখুঁতভাবে উড়ে যায় কীভাবে?

তারা কি না দেখেও দেখে?পাখিরা ‘না দেখে’ নয়, বরং মানুষের চেয়ে অনেক গুণ বেশি নিখুঁতভাবে দেখে। বেশিরভাগ পাখির চোখ মানুষের চেয়ে বড় এবং তীক্ষ্ণ হয়। কিছু পাখি যেমন বাজপাখি বা ঈগল ৩-৫ কিলোমিটার দূরের বস্তুও পরিষ্কারভাবে দেখতে পারে। মানুষের চোখে যেখানে প্রতি মিলিমিটারে ২০০,০০০ রিসেপ্টর থাকে, সেখানে ঈগলের চোখে থাকে প্রায় ১০ লক্ষ বেশি। কিছু পাখি অতিবেগুনি আলোও দেখতে পায়, যা মানুষ দেখতে পারে না। মানুষ শুধু দৃশ্যমান আলোর দেখে। এই কারণে পাখিরা দূর থেকে যেকোনো বাধা বা বিপদ আগে থেকেই চিনে ফেলে এবং তার অনুযায়ী দিক পরিবর্তন করে। পাখিদের চোখ সাধারণত মাথার দুই পাশে থাকে। ফলে তাদের মনোকুলার ভিশন অনেক উন্নত হয়। অর্থাৎ, এক চোখ দিয়ে একদিক এবং অন্য চোখ দিয়ে অন্যদিক দেখা সম্ভব। এর ফলে তারা প্রায় ৩৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে পারে। তবে শিকারী পাখিদের ক্ষেত্রে, যেমন ঈগল বা বাজপাখি, দুই চোখ সামনের দিকে থাকে, ফলে তারা Binocular vision ব্যবহার করে অনেক দূরের বস্তু নিখুঁতভাবে ট্র্যাক করতে পারে। পাখিরা আশপাশের দৃশ্য খুব দ্রুত রিড করে ফেলতে পারে এবং তা অনুযায়ী শরীর চালায়। তাদের মস্তিষ্কের optic tectum নামক অংশ খুব সক্রিয়, যা চোখ থেকে আসা তথ্য দ্রুত বিশ্লেষণ করে। এই প্রসেসিং স্পিড এত দ্রুত যে, তারা খুব কম সময়ে বাতাসে সামঞ্জস্য করতে পারে, এমনকি চলন্ত বাধাও এড়িয়ে যেতে পারে।

পাখিরা শুধু বস্তু নয়, বাতাস এবং চলন্ত পরিবেশও বোঝে। যখন তারা সামনে দিকে উড়ে, তখন তাদের আশেপাশের দৃশ্য একটা নির্দিষ্ট গতি ও আকারে সরে যেতে থাকে। এই গতিবিধি থেকে তারা বুঝতে পারে কোথায় বাধা, কোথায় ফাঁকা জায়গা। এই প্রক্রিয়াকে বলে optic flowএটি ঠিক সেইভাবে কাজ করে যেভাবে আমরা গাড়ি চালানোর সময় আশেপাশের বস্তু সরে যেতে দেখে গতি বুঝি। পাখির motor coordination চমৎকার। তাদের ডানার প্রতিটি নড়াচড়া মস্তিষ্কের নির্দেশনায় ঘটে, এবং তা ঘটে চোখের দেখার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। তাই বাতাসে উড়ার সময়, বাঁক নেয়ার সময়, বা গাছের ডালে বসার সময় তাদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক ছন্দ বজায় থাকে।পাখিরা তাদের চারপাশের পরিবেশ ও পথ চিনে রাখে। তারা প্রতিদিন যে রুটে উড়ে যায়, সেই জায়গাগুলো ধীরে ধীরে মস্তিষ্কে নকশা হিসেবে গেঁথে ফেলে। ফলে তারা নির্দিষ্ট জায়গায় গেলে বুঝতে পারে কোথায় কি আছে। উদাহরণঃ কাক, কবুতর বা শালিক প্রজাতির পাখিরা নির্দিষ্ট রাস্তা ধরে বাসায় ফিরে যেতে পারে – একে বলে navigational memory। পাখিরা শুধু দেখে না, শোনে এবং বাতাসের ধরণও বুঝে। বাতাসের ছোট ছোট পরিবর্তন তারা ডানার মাধ্যমে অনুভব করে এবং তার ভিত্তিতে দিক ঠিক করে নেয়।

অনেক সময় শিকারী পাখি তাদের শিকার দেখতে না পেলেও শব্দ বা বাতাসের কম্পন থেকে বুঝতে পারে। আপনি নিশ্চয় দেখেছেন, হাজার হাজার পাখি একসাথে আকাশে উড়ে যাচ্ছে, তবুও একটির সাথে অন্যটির ধাক্কা লাগে না। এটি সম্ভব হয় কারণ তারা “flocking behavior” অনুসরণ করে। প্রতিটি পাখি তার পাশের ৭-৮টি পাখির গতির উপর নজর রাখে। কেউ দিক বদলালে তার সাথে সাথেই বাকিরাও একইভাবে চলতে থাকে। এই আচরণ জেনেটিক্যালি নির্ধারিত এবং এটি mathematical rules অনুসরণ করে – যা বিজ্ঞানীরা Boids Algorithm দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। অতএব, পাখিরা “না দেখে” উড়ে না। বরং তারা এমনভাবে দেখে, বোঝে, অনুভব করে এবং আচরণ করে – যা মানুষের সাধ্যের বাইরে। তাদের দৃষ্টিশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, রিফ্লেক্স, দিক জ্ঞান এবং সমন্বয় এত উন্নত যে, মনে হয় তারা যেন ভবিষ্যৎও বুঝতে পারে! বিজ্ঞান বলছে, আমরা যতই প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাই না কেন, প্রকৃতির এই অসাধারণ জীবগুলোর প্রাকৃতিক দক্ষতার কাছাকাছি পৌঁছাতে আমাদের এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।

mehrab360
mehrab360https://www.mehrab360.com
হোসাইন হাওলাদার, mehrab360.com এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য, বিশ্লেষণ ও হালনাগাদ কনটেন্ট নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করে। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে জটিল প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো সহজভাবে তুলে ধরা। বিশ্বের প্রযুক্তি জগতের সর্বশেষ আপডেট, রিভিউ ও ব্যাখ্যামূলক কনটেন্ট পড়তে পারবেন। Email: info@mehrab360.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

এই সম্পর্কে আরো পড়ুন

ছায়া কি কখনো রঙিন হতে পারে?

ছোটবেলায় সবাই হয়তো খেয়াল করেছি, রোদে দাঁড়ালে পেছনে একটা কালো ছায়া পড়ে। তখন ভাবতাম, ছায়া মানেই অন্ধকার, ছায়া...

মাড়িতে থাকা ব্যাকটেরিয়ায় হৃদপিন্ডে সমস্যা হয়

মানুষের শরীর একটি বিস্ময়কর জৈব যন্ত্র। আমাদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। অনেক সময় আমরা...

ডেঙ্গু: জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি

বর্ষাকাল। গত কয়েকদিন ধরে ঝুমবৃষ্টি হয়েছে। আজকে আকাশে এক চিলতে রোদ দেখা যাচ্ছে। সাকিব নবম শ্রেণির বিজ্ঞানের ছাত্র।...

কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির নতুন আবিষ্কার: একীভূত তত্ত্বের পথে

বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন মহাবিশ্বের সব বল (forces) ও কণাগুলিকে একটি একীভূত তত্ত্বের মধ্যে সংযুক্ত...