ছোটবেলায় সবাই হয়তো খেয়াল করেছি, রোদে দাঁড়ালে পেছনে একটা কালো ছায়া পড়ে। তখন ভাবতাম, ছায়া মানেই অন্ধকার, ছায়া মানেই কালো। কিন্তু এই সহজ প্রশ্নটাই একদিন নতুন কৌতূহলের জন্ম দেয়ঃ ছায়া কি কখনো রঙিন হতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের আলো, ছায়া, প্রতিফলন এবং দৃষ্টিশক্তির জটিল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মধ্যে ডুব দিতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে – হ্যাঁ, ছায়া কখনো কখনো রঙিন হতে পারে। তবে সেটা নির্ভর করে অনেকগুলো পরিস্থিতির উপর। এখন ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করা যাক।ছায়া তখনই তৈরি হয়, যখন কোনো অস্বচ্ছ বস্তু (যার ভেতর আলো যেতে পারে না) আলো পথের মাঝে এসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ, ছায়া = আলোর অবরুদ্ধ অংশ। সূর্যের আলো বা কৃত্রিম আলোর উৎস যখন কোনো বস্তুর দিকে যায়, তখন সেই বস্তুটির পেছনে আলো পৌঁছাতে পারে না, ফলে সেখানে আলোহীন একটি অঞ্চল তৈরি হয় – এটিই ছায়া।
সাধারণভাবে এই ছায়া আমাদের কাছে কালো বা ধূসর দেখায়, কারণ সেখানে আলোর অভাব থাকে। ছায়া সবসময় কালো হয় না। যদিও বেশিরভাগ সময় আমাদের চোখে ছায়া কালচে দেখায়, কিন্তু প্রকৃতিতে এবং বিজ্ঞানে ছায়ার রঙ বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। এর পেছনে রয়েছে কিছু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। আমাদের চোখে তিন ধরনের কোষ থাকে, যেগুলো লাল, সবুজ এবং নীল আলো শনাক্ত করতে পারে। সূর্যের আলো আসলে একধরনের সাদা আলো, যা সাতটি রঙের সমন্বয়। এই রঙগুলো হলো, লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, বেগুনি ও ইন্ডিগো। যখন কোনো বস্তুর উপর আলো পড়ে, তখন সেই বস্তু কিছু রঙ শোষণ করে এবং কিছু রঙ প্রতিফলিত করে – যা আমাদের চোখে এসে পৌঁছে। ফলে আমরা সেই রঙ দেখি। যখন কোনো ছায়া তৈরি হয়, তখন আলো পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সেই অংশে কোনো নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো পৌঁছায় না – তাই সেটি কালচে দেখায়।
যদি এক জায়গায় একাধিক রঙিন আলো থাকে – যেমন নীল, লাল, বা সবুজ বাতি – এবং তাদের সামনে কোনো বস্তু রাখা হয়, তাহলে প্রতিটি আলোর বিপরীতে আলাদা আলাদা ছায়া পড়বে। এই ছায়াগুলো একেকটি নির্দিষ্ট আলোর অভাবের ফলে তৈরি হয়, তাই প্রতিটিই আলাদা রঙের হয়। একটি কক্ষে যদি লাল, নীল ও সবুজ রঙের তিনটি স্পটলাইট থাকে, এবং সামনে একটি বল রাখা হয়, তাহলে তিন দিক থেকে তিনটি রঙিন ছায়া পড়বে। এগুলোকে বলে রঙিন ছায়া (Colored Shadows)। কখনো-কখনো ছায়ার উপর কাছাকাছি কোন রঙিন বস্তু থেকে প্রতিফলিত আলো পড়ে। ফলে সেই ছায়াটি সেই রঙে রঙিন দেখাতে পারে। ধরি, একটি সাদা দেয়ালে আপনার ছায়া পড়েছে। কিন্তু পাশেই একটি কমলা রঙের কাগজ রাখা আছে, যা সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে ছায়ার উপর পড়ছে। তখন সেই ছায়া কমলা আভায় রঙিন দেখা যেতে পারে।
সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয়ের সময় আলোর রঙ বদলায় – তখন সূর্যের আলোতে লাল বা কমলা রঙের আধিক্য থাকে। এই সময় যদি ছায়া দেখা যায়, তাহলে তা অনেক সময় একটু লালচে বা বেগুনি আভা ধারণ করে। এটি ঘটে কারণ তখন সূর্যের আলো আমাদের বায়ুমণ্ডল দিয়ে অনেকটা পথ অতিক্রম করে আসে, যেখানে নীল আলো বেশি ছড়িয়ে যায় এবং লাল আলো সরাসরি পৌঁছে যায় – একে বলে Rayleigh scattering। কখনো আপনি যদি পানির নিচে কোনো বস্তুর ছায়া দেখেন, তা অনেক সময় সবুজ বা নীলচে হতে পারে। এর কারণ হচ্ছে পানি বা কাচ রঙের বিকিরণ ভিন্নভাবে শোষণ করে। পানির নিচে আলোর গতিপথ ও বিভাজন অনেক জটিল – ফলে ছায়া রঙিন হতে পারে।মানবচোখ রঙ ও ছায়া একসাথে বিশ্লেষণ করে। অনেক সময়, আমাদের চোখে অপটিক্যাল ইলিউশন তৈরি হয় – মনে হয় ছায়া রঙিন, যদিও সেটি বাস্তবে হয়তো নয়। বিখ্যাত “Checker shadow illusion” ছবিতে মনে হয় দুটি ঘরের রঙ আলাদা, যদিও তারা একই। রঙিন ছায়া নিয়ে বহু বিজ্ঞানী ও শিল্পী গবেষণা করেছেন। শিল্পকলায় যেমন “Chiaroscuro” পদ্ধতি ছায়া ও আলো নিয়ে কাজ করে, তেমনি বিজ্ঞানের দিক থেকেও wave interference, color mixing, ও spectral analysis–এর মাধ্যমে রঙিন ছায়ার উপস্থাপন করা হয়।
ছায়া কি রঙিন হতে পারে? হ্যাঁ – এবং এটি শুধু সম্ভাব্য নয়, বাস্তবে ঘটে। তবে ছায়া যে রঙ ধারণ করবে, তা নির্ভর করে অনেকগুলো জিনিসের উপর – আলোর উৎস, আলোর রঙ, প্রতিবিম্ব, আশপাশের বস্তু, এমনকি আমাদের চোখের অনুভূতির উপরও।এই ছোট্ট প্রশ্নটি যেন আমাদের শেখায় – জগতে কিছুই সাদামাটা নয়, সবকিছুর পেছনে লুকিয়ে থাকে এক গভীর বিজ্ঞান ও সৌন্দর্য।