আল-খোয়ারিজমি বীজগণিতের জনক!

Date:

শেয়ারঃ

বিজ্ঞাপন
Google News Logo

নতুন পোস্ট ও আপডেট পেতে এখনই Google News-এ আমাদের চ্যানেল ফলো করুন।

🔗 ফলো করুন Google News-এ

গণিতের বিশেষ একটি শাখার নাম বীজগণিত। আমরা ছোটবেলা থেকে গণিতে অনেক সমস্যার সমাধানে ‘মনে করি’ বলে অজানা রাশি ধরে নিয়েছি, যেমন x, y বা z।

কিন্তু এই বীজগণিতের সূচনা কোথা থেকে? কে এর জনক?

এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে। প্রায় ১২০০ বছর আগের এক সময়ে, যখন ইউরোপ জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত ছিল। কিন্তু আরব বিশ্ব ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানে উজ্জ্বল। সে সময়কার অন্যতম উন্নত শহর ছিল, বর্তমান ইরাকের বাগদাদ। এখানে খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে, এক বিশাল লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র ‘বায়তুল হিকমাহ’ বা হাউজ অব উইজডম।

Al Khwarizmi
এআই দিয়ে নির্মিত

সেখানেই কাজ করতেন মুসা আল-খোয়ারিজমি। যাঁকে বলা হয় বীজগণিতের জনক। মুসা আল-খোয়ারিজমি জন্মগ্রহণ করেন খোয়ারিজমি নামে এক অঞ্চলে। যা তখন পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তানের অংশ। তাঁর পুরো নাম মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খোয়ারিজমি। যার অর্থ, খোয়ারিজমি অঞ্চল থেকে আগত ব্যক্তি।

তিনি বড় হন এক বৈচিত্র্যময় পরিবেশে। যেখানে গ্রিক, পারসিয়ান, ভারতীয় ও আরবীয় সংস্কৃতির মিলন ঘটত। পরবর্তীতে তিনি বাগদাদে এসে বায়তুল হিকমায় যোগ দেন। গ্রিক দার্শনিক ইউক্লিডের জ্যামিতি, ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতি এবং পারসীয় জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে গভীরভাবে কাজ করতেন। দীর্ঘদিন গবেষণার মাধ্যমে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হয়ে ওঠেন।

তাঁর তত্ত্বাবধানে বহু গ্রিক ও ভারতীয় গ্রন্থ আরবিতে অনূদিত হয়। তবে তিনি শুধু অনুবাদক ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক উদ্ভাবকও। মুসা আল-খোয়ারিজমি লক্ষ্য করেন, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যেমন, উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি ভাগ, জমির মাপজোক, ব্যবসার হিসাবের মতো বহু সমস্যার নিরসনে একটি সাধারণ পদ্ধতির দরকার।

এই লক্ষ্যেই তিনি ৮২০ সালে রচনা করেন, বিখ্যাত বই “আল-কিতাব আল-মুখতাসার ফি হিসাব আল-জাবর ওয়াল-মুকাবালা”। যার অর্থ পূর্ণতা ও ভারসাম্যের হিসাব নিয়ে সংক্ষিপ্ত বই। এই বইয়ের নামেই লুকিয়ে আছে বীজগণিতের মূল সূত্র। তিনি এই বইয়ে দুটি মূল নিয়ম উপস্থাপন করেন ‘আল-জাবর’ ও ‘আল-মুকাবালা’।

গণিত সম্পর্কে আরো পড়ুন

‘আল-জাবর’ শব্দের অর্থ, ভাঙা জিনিসকে জোড়া লাগানো। গণিতের ভাষায়, এটি সমীকরণের এক পাশে থাকা ঋণাত্মক সংখ্যা অন্য পাশে নিয়ে গিয়ে ধনাত্মক করার নিয়ম। যেমন, x − 5 = 10 হলে, -5 কে ডান পাশে নিয়ে গেলে x = 10 + 5, অর্থাৎ x = 15। এখান থেকেই এসেছে ইংরেজি শব্দ ‘Algebra’, যার বাংলা অর্থ বীজগণিত।

দ্বিতীয় নিয়ম ‘আল-মুকাবালা’-এর অর্থ, মুখোমুখি করা, ভারসাম্য রক্ষা করা। যেমন, x + 7 = y + 7 হলে, দুই পাশ থেকে ৭ বাদ দিয়ে পাওয়া যায় x = y। এই পদ্ধতি একদিকে সমীকরণকে সহজ করে তোলে, অন্যদিকে গণনার মধ্যে ভারসাম্য আনে। এই দুটি নিয়ম ব্যবহার করেই মুসা আল-খোয়ারিজমি, একটি গোছানো সমীকরণ সমাধানের পদ্ধতি তৈরি করেন।

তিনিই প্রথম দেখান, কীভাবে x বা y ধরার মাধ্যমে অজানা রাশির মান বের করা যায়। দ্বিঘাত সমীকরণেরও পদ্ধতিগত সমাধান তিনিই প্রথম দেন। তাঁর অবদান শুধু বীজগণিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ‘আলগোরিদম’ শব্দটি তাঁর নামের ল্যাটিন রূপ Algoritmi থেকে এসেছে।

অ্যালগরিদম মানে কোনো কাজ ধাপে ধাপে সম্পন্ন করার পদ্ধতি। যা আজকের কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভিত্তি। তিনি ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেন। দেখান যে, রোমান সংখ্যার তুলনায় এই পদ্ধতি অনেক সহজ ও কার্যকর। এই সংখ্যাপদ্ধতির ওপর লেখা তাঁর বই প্রথমে আরববিশ্বে এবং পরে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি বড় সংখ্যার গুণফল নির্ণয়ে ‘জাল পদ্ধতি’ নামক এক কৌশল তৈরি করেন। যেখানে একটি জালের মতো ছক কেটে সংখ্যাগুলো বসিয়ে গুণফল বের করা হতো। পরে এই পদ্ধতিই ইউরোপে পৌঁছে দেন ইতালীয় গণিতবিদ ফিবোনাচ্চি। আল-খোয়ারিজমির অবদান জ্যোতির্বিদ্যাতেও অসামান্য।

তিনি সূর্য এবং নক্ষত্রের পর্যবেক্ষণ করে একটি যন্ত্র তৈরি করেন ‘কোয়াড্রেন্ট’। যার মাধ্যমে সময় নির্ণয় করা যেত। তিনি ‘জিজ আল-সিন্ধিন্দ’ নামে একটি জ্যোতির্বিদ্যার সারণি প্রস্তুত করেন। যার মাধ্যমে সূর্য, চাঁদ ও গ্রহের অবস্থান নির্ণয় করা যেত।

এমনকি সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের সময়ও, এই সারণি থেকে নির্ণয় সম্ভব ছিল। তিনি সূর্যঘড়ি তৈরি করেন, যা মসজিদে নামাজের সময় নির্ধারণে ব্যবহৃত হতো। ইহুদি ক্যালেন্ডার নিয়েও গবেষণা করেন। যদিও তাঁর জ্ঞান ও কাজ বিস্তৃত ছিল। তবে তাঁর মূল অবদান গণিতেই।

আজকের দিনে যখন আমরা স্মার্টফোন ব্যবহার করি। ইন্টারনেট ঘাঁটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা নতুন ওষুধ তৈরি করি। সেখানেও ব্যবহৃত হয় বীজগণিত ও অ্যালগরিদম। মুসা আল-খোয়ারিজমি শুধু গণিতের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেননি। তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, বিভিন্ন সংস্কৃতির জ্ঞান একত্রিত করে, নতুন কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব।

তিনি গ্রিক জ্যামিতি, ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতি, পারসীয় জ্যোতির্বিদ্যা ও আরবীয় বাস্তবতাকে একত্রিত করে, তৈরি করেছিলেন আধুনিক গণিতের ভিত্তি। তিনি প্রমাণ করে গেছেন, জ্ঞান সীমাবদ্ধ নয়, আর কৌতূহল ও পরিশ্রম দিয়েই বদলে ফেলা যায় পুরো পৃথিবীকে।

আজও যখন কোনো শিক্ষার্থী প্রথমবার বীজগণিত শেখে। তখন সে আল-খোয়ারিজমির দেখানো পথেই হাঁটে। কোনো বিজ্ঞানী নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চাইলে, তিনি খোয়ারিজমির তৈরি করা গণিতের হাতিয়ারই ব্যবহার করেন। এভাবেই মুসা আল-খোয়ারিজমি চিরকাল গণিতের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।

mehrab360
mehrab360https://www.mehrab360.com
হোসাইন হাওলাদার, mehrab360.com এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য, বিশ্লেষণ ও হালনাগাদ কনটেন্ট নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করে। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে জটিল প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো সহজভাবে তুলে ধরা। বিশ্বের প্রযুক্তি জগতের সর্বশেষ আপডেট, রিভিউ ও ব্যাখ্যামূলক কনটেন্ট পড়তে পারবেন।

মন্তব্য করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
নাম লিখুন দয়া করে

বিজ্ঞাপনspot_img

এই সম্পর্কে আরো পড়ুন

আসলেই কি প্রাণীরা গণিত বোঝে?

আপনার বাসায় যদি পোষা বিড়াল থাকে আর হঠাৎ একদিন দেখলেন সে বসে কিছু যেন গুনছে, তাহলে অবাক হবেন...

গণিতের জাদুকরঃ শ্রীনিবাস রামানুজান

শ্রীনিবাস রামানুজান ছিলেন এক বিস্ময়কর গণিত প্রতিভা, যিনি বিনা আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় গণিতের গভীরতম রহস্য উন্মোচন করেছিলেন। ১৮৮৭ সালের...

বৃত্ত কেন ৩৬০ ডিগ্রি?

বৃত্তের পরিধি কেন ৩৬০ ডিগ্রিতে বিভক্ত, এটি একটি প্রাচীন এবং রহস্যময় গণিতীয় সিদ্ধান্ত। যদিও এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে...