মানুষের শরীর একটি বিস্ময়কর জৈব যন্ত্র। আমাদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। অনেক সময় আমরা ধারণাও করি না যে এক অঙ্গের সমস্যা অন্য অঙ্গের উপর কতটা প্রভাব ফেলতে পারে। ঠিক তেমনই, দাঁতের মাড়ির রোগ বা গাম ডিজিজ শুধুমাত্র মুখগহ্বরেই সীমাবদ্ধ নয় — এটি আমাদের হৃদযন্ত্রের উপরও গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।মাড়ির রোগ, যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় “পিরিয়োডোন্টাল ডিজিজ” বলা হয়, দাঁতের চারপাশের টিস্যুতে সংক্রমণজনিত প্রদাহকে বোঝায়। এই রোগ সাধারণত প্লাক এবং টার্টারের অতিরিক্ত জমা হওয়া থেকে শুরু হয়। এগুলোতে থাকা ব্যাকটেরিয়া ধীরে ধীরে মাড়ির গভীরে প্রবেশ করে এবং সেখানকার টিস্যু ধ্বংস করতে শুরু করে।
কীভাবে মাড়ির ব্যাকটেরিয়া হৃদস্পন্দনে প্রভাব ফেলে?
প্রথমে বোঝা দরকার, কীভাবে মাড়ির ব্যাকটেরিয়া রক্তপ্রবাহে পৌঁছায়। যখন মাড়ি ফুলে যায় বা ক্ষত হয়, তখন ব্যাকটেরিয়া সহজেই সেখান থেকে রক্তনালীতে প্রবেশ করতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়া একবার রক্তে প্রবেশ করলে তা হৃদপিণ্ডে গিয়ে সংক্রমণ বা প্রদাহ ঘটাতে পারে। এই অবস্থাকে বলে ব্যাকটেরিয়াল এন্ডোকার্ডাইটিস, যা হৃদপিণ্ডের ভাল্ব বা অভ্যন্তরীণ আবরণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের (HU) একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে যে মাড়ির রোগের ব্যাকটেরিয়া Porphyromonas gingivalis ( P. gingivalis ) রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করতে পারে এবং হৃদপিণ্ডে অনুপ্রবেশ করতে পারে। সেখানে, এটি নীরবে দাগের টিস্যু তৈরিতে সাহায্য করে – যা ফাইব্রোসিস নামে পরিচিত – হৃদপিণ্ডের গঠনকে বিকৃত করে, বৈদ্যুতিক সংকেতে হস্তক্ষেপ করে এবং অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন (AFib) এর ঝুঁকি বাড়ায়। আরোএকটি গবেষণায় দেখা যায়, যাদের দাঁতের মাড়িতে দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ আছে, তাদের শরীরে C-reactive protein (CRP) এবং অন্যান্য প্রদাহজনক উপাদানের মাত্রা বেশি থাকে। এই উপাদানগুলো সরাসরি হৃদপিণ্ডে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যার ফলস্বরূপ হৃদস্পন্দনে অনিয়ম এবং হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
যেসব হৃদরোগ হতে পারেঃ
- ১. এন্ডোকার্ডাইটিস
২. অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস (রক্তনালীর সংকোচন)
৩. মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (হার্ট অ্যাটাক)
৪. স্ট্রোক (যদি মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়)
৫. হৃদপিণ্ডের ভাল্ব ক্ষয়জনিত সমস্যা
যদি মাড়ির সমস্যার কারণে হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়, তবে একইসাথে দুই দিক থেকেই চিকিৎসা নিতে হবে। ডেন্টিস্ট ও কার্ডিওলজিস্ট একযোগে কাজ করবেন। মাড়ির ইনফেকশন কমাতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হতে পারে, এবং হৃদরোগের জন্য বিশেষ ওষুধ প্রয়োগ করা হবে। মুখের স্বাস্থ্য আর হৃদয় — এই দুটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন একে অপরের সঙ্গে অদৃশ্য বন্ধনে জড়িত। একটি অবহেলায় অন্যটির উপরও বিপদ নেমে আসতে পারে। তাই দাঁতের যত্ন শুধু দাঁতের জন্যই নয়, হৃদয়ের জন্যও জরুরি। মনে রাখবেন —”সুস্থ মাড়ি, সুস্থ হৃদয়”। এখনই নিয়মিত দাঁতের যত্ন নেওয়া শুরু করুন, কারণ একটি হাসি হতে পারে হৃদয় রক্ষার প্রথম পদক্ষেপ।