অগ্নিশিখার রহস্যঃ অক্সিজেনের আবিষ্কার

Date:

শেয়ারঃ

আমরা যে প্রতি মুহূর্তে শ্বাস নিই, সেই বাতাসটা আসলে কী দিয়ে তৈরি? আবার ধরুন, মোমবাতি বা চুলার আগুন এগুলো কেন জ্বলে?

আজ আপনি হয়তো এক নিমিষেই উত্তর দেবে, কারণ বাতাসে অক্সিজেন আছে। কিন্তু আপনাকে যদি বলা হয়, এমন একটা সময় ছিল যখন পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষেরাও জানতো না এই অক্সিজেন জিনিসটা আসলে কী?

তারা আগুন দেখে অবাক হতো, শ্বাস-প্রশ্বাস কেন চলে তা নিয়ে মাথা ঘামাতো, কিন্তু বাতাসের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এই জাদুকরী উপাদানটির কোনও ধারণাই তাদের ছিল না। অথচ এই অক্সিজেন ছাড়া না আগুন জ্বলবে, না আমরা বা অন্য কোনও প্রাণী এক মুহূর্তও বাঁচতে পারবো

আরো পড়ুনঃ মানুষের দুটি ছায়া কখন দেখা যায়?

আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেকার কথা। প্রাচীন গ্রিসের বিখ্যাত দার্শনিক, যেমন এস্পেডোক্লিস (Empedocles) বা তারও পরে অ্যারিস্টটল (Aristotle), মনে করতেন, পৃথিবীর সবকিছু মাত্র চারটি মৌলিক উপাদান দিয়ে তৈরিঃ মাটি, পানি, বাতাস আর আগুন।

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ, আগুনকেও তারা বাতাসের মতোই এক ধরনের মূল উপাদান ভাবতেন!

ভাবতে পারেন ব্যাপারটা? তাদের ধারণা ছিল, যেকোনো জিনিস আসলে এই চার উপাদানের বিভিন্ন অনুপাতের মিশ্রণ। যখন কোনও কিছু পোড়ে, তখন তার ভেতরের উপাদানগুলো আলাদা হয়ে যায়। তাদের মতে, যখন কাঠ জ্বলে, তখন কাঠের ভেতর থেকে আগুন বেরিয়ে আসে শিখা হয়ে, ধোঁয়া হয়ে বাতাসে মিশে যায়, কাঠের ভেতরের পানি ফটফট শব্দ করে বেরোয়, আর যেটা থেকে যায় তা হলো ছাই, যেটা মাটির অংশ।

এই ধারণাটা এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে প্রায় দুই হাজার বছর ধরে মানুষ এটাই বিশ্বাস করে এসেছে। কেউ এর বিরুদ্ধে জোরালো কোনও প্রশ্ন তোলেনি।

V0000426 Johann Joachim Becher. Line engraving by W. P. Kilian, 1675.
Credit: Wellcome Library, London. Wellcome Images
images@wellcome.ac.uk
http://wellcomeimages.org
Johann Joachim Becher. Line engraving by W. P. Kilian, 1675.
Published: –

Copyrighted work available under Creative Commons Attribution only licence CC BY 4.0 http://creativecommons.org/licenses/by/4.0/

সময় গড়িয়ে গেল। ১৬৬৭ সালে জার্মান রসায়নবিদ যোহান বেশার নতুন একটা তত্ত্ব দিলেন।

তিনি বললেন, সব কিছু তিন ধরনের “মাটি” দিয়ে তৈরিঃ পাথুরে মাটি (যা জিনিসকে গলাতে সাহায্য করে), তরল মাটি (যা জিনিসকে উদ্বায়ী বা সহজে উড়ে যেতে সাহায্য করে) আর তৈলাক্ত বা চর্বিজাতীয় মাটি (terra pinguis)। বেশার মতে, এই টেরা পিঙ্গুইসই জিনিসকে জ্বলতে সাহায্য করে। যখন কিছু জ্বলে, তখন এই চর্বিযুক্ত মাটি বেরিয়ে যায়, আর তাই শিখা হয়।

পরে বেশারের ছাত্র জর্জ আর্নস্ট স্টল এই তত্ত্বটাকে আরও উন্নত করলেন। তিনি টেরা পিঙ্গুইসের নাম দিলেন “ফ্লজিস্টন”। গ্রিক শব্দ ‘ফ্লক্স” থেকে এসেছে এই নাম, যার মানে শিখা। স্টল বললেন, যেসব জিনিসে ফ্লজিস্টন বেশি থাকে, সেগুলো বেশি জ্বলে। উদাহরণস্বরূপ, কাঠ বা কয়লায় ফ্লজিস্টন অনেক থাকে, তাই এগুলো ভালো জ্বলে। আর পাথরে ফ্লজিস্টন নেই বললেই চলে, তাই পাথর জ্বলে না।

এই ফ্লজিস্টন তত্ত্ব তখনকার সময় এতটাই গ্রহণযোগ্যতা পায় যে ইউরোপের রসায়নবিদরা প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটাকেই সত্যি বলে ধরে নেন। তারা মনে করতেন, যখন কিছু জ্বলে, তখন আসলে তার ভেতরের ফ্লজিস্টন বাতাসে উড়ে যায়।

কিন্তু এখানেই শুরু হলো নতুন ধরণের প্রশ্ন।

যখন বিজ্ঞানীরা ধাতু গরম করে দেখলেন, ধাতু জ্বলে না ঠিকই, কিন্তু গরম হলে তা পুড়ে এক ধরনের গুঁড়ো বা ছাইয়ের মতো বস্তুতে পরিণত হয় যাকে বলা হতো “ক্যালক্স”। আশ্চর্যের বিষয়, এই গুঁড়োর ওজন দেখা গেল আগের ধাতুর চেয়েও বেশি!

Georg-Ernst-Stahl

তাহলে যদি ফ্লজিস্টন বেরিয়ে গিয়ে হালকা হয়ে যাওয়ার কথা হয়, ওজন বরং বেশি কেন হচ্ছে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে ইতিহাসে আবির্ভাব হলো এক নতুন যুগের — আধুনিক রসায়নের জন্মদাতা হিসেবে যাকে ধরা হয়, সেই অ্যান্টনি ল্যাভয়জিয়ে। ১৭৭০ এর দশকে ল্যাভয়জিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। তিনি বুঝতে পারলেন, যখন কোনো পদার্থ জ্বলে, তখন আসলে তা বাতাসের এক বিশেষ উপাদানের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এবং সেই উপাদানের কারণেই জ্বলা সম্ভব হচ্ছে।

আরো পড়ুনঃ ছায়া কি কখনো রঙিন হতে পারে?

এই বিশেষ উপাদানটিই ছিল অক্সিজেন। ল্যাভয়জিয়ে প্রমাণ করলেন, বাতাসে অনেক গ্যাস থাকলেও “অক্সিজেন” নামক গ্যাসটি হলো আগুন জ্বলার মূল উপাদান এবং এটি জীবজগতের শ্বাস-প্রশ্বাসেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যখন কিছু পোড়ে, তখন ফ্লজিস্টন বেরিয়ে যায় না; বরং বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে মিলিত হয়।

তিনি দেখালেন, ধাতু পুড়ে যে গুঁড়ো তৈরি হয়, সেটার ওজন বাড়ে কারণ সেটি অক্সিজেন শোষণ করে। এই আবিষ্কার একেবারে বদলে দিল মানুষের চিন্তাভাবনা। ধ্বংস হলো বহু পুরোনো বিশ্বাস, জন্ম নিল আধুনিক রসায়নের, যেখানে প্রতিটি মৌল ও যৌগকে আলাদা করে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। আজকে আমরা জানি, বাতাস মূলত নাইট্রোজেন (প্রায় ৭৮%), অক্সিজেন (প্রায় ২১%), আর বাকি অংশে কার্বন ডাই-অক্সাইড, আর্দ্রতা ও নানা গ্যাসের মিশ্রণ।

আমরা যখন শ্বাস নিই, তখন এই অক্সিজেনই আমাদের শরীরের কোষে গিয়ে শক্তি উৎপাদনের কাজে লাগে। আবার আগুন জ্বালানোর সময়ও এটি মৌলিক ভূমিকা রাখে। একসময় যেটা ছিল অলৌকিক বা রহস্য, আজ তা বিজ্ঞানের আলোয় পরিষ্কার, যে অক্সিজেনের আবিষ্কার আমাদের শুধু রসায়নের জগতে নয়, গোটা সভ্যতার অগ্রগতির পথে এক বিশাল মাইলফলক।

তাই পরের বার যখন মোমবাতির শিখা দেখতে দেখবে, কিংবা গভীর করে একটা নিঃশ্বাস নেবে একটু থেমে ভেবে নিন, এই অক্সিজেন আবিষ্কারের পেছনে কত শত বছরের সাধনা, ভুল তত্ত্ব, প্রশ্ন আর সাহসী অনুসন্ধান লুকিয়ে আছে।

mehrab360
mehrab360https://www.mehrab360.com
হোসাইন হাওলাদার, mehrab360.com এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য, বিশ্লেষণ ও হালনাগাদ কনটেন্ট নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করে। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে জটিল প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো সহজভাবে তুলে ধরা। বিশ্বের প্রযুক্তি জগতের সর্বশেষ আপডেট, রিভিউ ও ব্যাখ্যামূলক কনটেন্ট পড়তে পারবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

বিজ্ঞাপনspot_img

এই সম্পর্কে আরো পড়ুন

পানামা খাল কেন তৈরি করা হয়েছিল?

ধরুন আপনি একজন নাবিক, বিশাল সমুদ্রযাত্রায় বের হয়েছেন। পাড়ি দিতে হবে আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগর। কিন্তু সামনে এক...

গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রাণীরা এত রঙিন কেন?

গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের বনজঙ্গল, নদী ও সমুদ্রের পানির নিচে থাকা প্রাণীগুলোকে দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এদের শরীরজুড়ে থাকে লাল,...

মস্তিষ্কের কোষ কোন বয়সে বাড়ে?

বিকাশিত মানুষের মস্তিষ্ক যখন গর্ভে তখন কোটি কোটি নিউরন অর্জন করে এবং শৈশবে আরও কিছু নিউরনকে কাজে লাগায়।...

Google Pay বাংলাদেশে আসছে! সুবিধা কি?

গুগল পে আগামী এক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশে চালু হতে যাচ্ছে। অনেকেই এই বিষয় নিয়ে জানতে চাচ্ছে। অনেক ধরনের...