গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রাণীরা এত রঙিন কেন?

Date:

শেয়ারঃ

গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের বনজঙ্গল, নদী ও সমুদ্রের পানির নিচে থাকা প্রাণীগুলোকে দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এদের শরীরজুড়ে থাকে লাল, নীল, হলুদ, সবুজসহ নানা উজ্জ্বল রঙ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই প্রাণীরা এত রঙিন কেন? এর পেছনে আছে কিছু বৈজ্ঞানিক ও পরিবেশগত কারণ।
সংগৃহীত livescience.com
গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের আলো ও আবহাওয়া প্রাণীদের রঙিন হওয়ার অন্যতম কারণ। এই অঞ্চলে সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে এবং অনেক বেশি সময় জুড়ে বিদ্যমান থাকে। ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত আলো থাকে।

এই অধিক আলো প্রাণীদের শরীরের রঙ আরও উজ্জ্বলভাবে ফুটিয়ে তোলে। অন্যদিকে, মেরু অঞ্চল বা বনাঞ্চলের গভীরে আলো কম থাকায় সেখানে প্রাণীরা তুলনামূলকভাবে ধূসর, বাদামি বা একরঙা হয়ে থাকে। রঙিনতা অনেক সময় প্রাণীদের জন্য একটি প্রতিরক্ষা কৌশল। কিছু প্রাণী উজ্জ্বল রঙের মাধ্যমে শিকারীদের বিভ্রান্ত করে বা ভয় দেখায়।

যেমন, বিষধর ব্যাঙ বা পোকামাকড়দের শরীরে উজ্জ্বল লাল, কমলা বা হলুদ রঙ থাকে, যা দেখে শিকারীরা বুঝতে পারে যে এরা বিষাক্ত হতে পারে। একে বলে অ্যাপোজমেটিক রঙ। আবার কিছু মাছ বা প্রজাপতিরা তাদের রঙের মাধ্যমে আশেপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিশে যায়, যাতে শিকারী সহজে তাদের খুঁজে না পায়। একে বলে ক্যামোফ্লাজ বা ছদ্মবেশ। গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রাণীদের রঙিনতার পেছনে যৌন নির্বাচন (sexual selection) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

অনেক পুরুষ পাখি, মাছ বা পতঙ্গ রঙিন হয় স্ত্রীসঙ্গীকে আকর্ষণ করার জন্য। যেমন, ময়ূর বা প্যারাডাইস বার্ডের মতো পাখিরা তাদের উজ্জ্বল পালকের মাধ্যমে মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে প্রতিযোগিতা বেশি থাকায় পুরুষ প্রাণীরা নিজেদের আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে রঙিন হয়ে উঠেছে।

এই অঞ্চলে খাদ্য ও পুষ্টির প্রাচুর্য রয়েছে, যা প্রাণীদের শরীরে বিভিন্ন রঞ্জক (pigment) তৈরিতে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, গাজরের বিটা-ক্যারোটিন বা কিছু উদ্ভিদের অ্যান্থোসায়ানিন নামক রঞ্জক প্রাণীদের খাদ্যের মাধ্যমে তাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং শরীরকে উজ্জ্বল রঙে রাঙায়।

এই অঞ্চলের প্রাণীরা বিভিন্ন ফল, ফুল ও পতঙ্গ খেয়ে শরীরে এসব রঞ্জক জমা করে রঙিন হয়ে ওঠে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানে লাখ লাখ প্রজাতির প্রাণী বাস করে, যাদের প্রত্যেকেই নিজেদের আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রকাশে রঙের ব্যবহার করে। পরিবেশগত প্রতিযোগিতা ও অভিযোজনের কারণে প্রতিটি প্রজাতি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা ও প্রজনন বাড়ানোর জন্য স্বতন্ত্র রঙের রূপ ধারণ করে।

বিশেষ করে পাখিরা পৃথিবীকে উপলব্ধি করার জন্য তাদের দৃষ্টিশক্তির উপর নির্ভর করে। বনের পরিবেশে পাখির প্রজাতির সংখ্যা এত বেশি যে তারা নিজেদের আলাদা করে তুলে ধরার জন্য এই প্রতিযোগিতাকে ত্বরান্বিত করে, যার ফলে তোতাপাখি, হামিংবার্ড, টোকান এবং গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলকে আবাসস্থল বলে ডাকা অন্যান্য পাখিদের রঙ এবং নকশার অসাধারণ বৈচিত্র্য দেখা যায়।

তবে, আমাদের এই রঙ এবং রঙের ধরণ সম্পর্কে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। আমরা যেভাবে রঙ উপলব্ধি করি তা অন্যান্য প্রাণীদের উপলব্ধির চেয়ে অনেক আলাদা হতে পারে। বিশেষ করে সামুদ্রিক জলপ্রণালীর ক্ষেত্রে এটি সত্য। আলো জলের মধ্য দিয়ে যেভাবে ভ্রমণ করে, লাল রঙ অত্যন্ত দ্রুত শোষিত হয়, যা বিপরীতভাবে এটিকে ছদ্মবেশের জন্য আদর্শ রঙ করে তোলে।

একইভাবে, উজ্জ্বল নকশা যা মানুষের চোখে আড়ম্বরপূর্ণ বলে মনে হয়, অনেক ছোট মাছকে প্রবাল প্রাচীরের স্বচ্ছ জলে শিকারীদের হাত থেকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করে। প্রাচীর মাছের নীল এবং হলুদ রঙ অনেক বেশি থাকে, কিন্তু অনেক মাছই তা দেখতে পায় না।

এগুলো এমন রঙ যার বৈসাদৃশ্য খুবই তীব্র, তাই তারা ছদ্মবেশ ধারণের জন্য তাদের সিলুয়েট ভাঙতে এটি ব্যবহার করে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রাণীদের রঙিনতার পেছনে রয়েছে আলোর প্রভাব, প্রতিরক্ষা কৌশল, যৌন নির্বাচন, খাদ্য ও পুষ্টির ভূমিকা এবং পরিবেশগত বৈচিত্র্য। এই কারণগুলোর মিলিত প্রভাবে তারা এত চমকপ্রদ ও চোখধাঁধানো রঙের অধিকারী হয়ে উঠেছে, যা শুধু প্রকৃতির নয়, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও এক বিস্ময়কর বিষয়।

শক্তির দিক থেকে পরিবেশ আরও উদার, খাদ্যের প্রাপ্যতা, মৃদু জলবায়ু, যা গ্রীষ্মমন্ডলীয় পরিবেশে প্রাণীদের শারীরবৃত্তের উপর শক্তিশালী প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন প্রজাতি আসলে রঙের জন্য আরও বেশি শক্তি বিনিয়োগ করতে পারে কারণ সেখানে আরও প্রাচুর্য থাকে এবং খুব রঙিন হওয়ার শারীরবৃত্তীয় খরচ হ্রাস পায়।

বিবর্তনের সুবিধা যাই হোক না কেন, প্রাণীদের রঙ তাদের পরিবেশের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, তা সে রেইনফরেস্টের উজ্জ্বল পাখি হোক বা গভীর সমুদ্রের নিস্তেজ রূপালী মাছ। এবং জটিল এবং বৈচিত্র্যময় গ্রীষ্মমন্ডলীয় বাস্তুতন্ত্র প্রতিযোগিতা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের নিখুঁত মিশ্রণ প্রদান করে যা প্রাণবন্ত রঙের একটি দুর্দান্ত বিস্ফোরণকে সমর্থন করে।
mehrab360
mehrab360https://www.mehrab360.com
হোসাইন হাওলাদার, mehrab360.com এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য, বিশ্লেষণ ও হালনাগাদ কনটেন্ট নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করে। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে জটিল প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো সহজভাবে তুলে ধরা। বিশ্বের প্রযুক্তি জগতের সর্বশেষ আপডেট, রিভিউ ও ব্যাখ্যামূলক কনটেন্ট পড়তে পারবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

বিজ্ঞাপনspot_img

এই সম্পর্কে আরো পড়ুন

মস্তিষ্কের কোষ কোন বয়সে বাড়ে?

বিকাশিত মানুষের মস্তিষ্ক যখন গর্ভে তখন কোটি কোটি নিউরন অর্জন করে এবং শৈশবে আরও কিছু নিউরনকে কাজে লাগায়।...

Google Pay বাংলাদেশে আসছে! সুবিধা কি?

গুগল পে আগামী এক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশে চালু হতে যাচ্ছে। অনেকেই এই বিষয় নিয়ে জানতে চাচ্ছে। অনেক ধরনের...

টর্নেটো যেভাবে তৈরি হয়

আমরা সকলেই টর্নেডো সম্পর্কে জানি। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি যে টর্নেডো কিভাবে সৃষ্টি হয়। বায়ুর এক ধরনের...

মিঠাপানি উৎস খুবই সামান্য!

আপনি জানেন কি! ভূ-পৃষ্ঠের প্রায় ৭৫% পানি হলেও মিঠাপানির উৎস খুব সামান্য। বেশিরভাগ পানি পানযোগ্য নয়। পৃথিবীর মোট...