ঘূর্ণিঝড় কেন হয় এবং কিভাবে সৃষ্টি হয় এসব তথ্য নিয়ে আজকের আপডেট এ কথা বলা হবে। ঘূর্ণিঝড় কেন হয় এ সম্পর্কে আমাদের জানতে হলে আর্দ্রতা সম্পর্কে জানতে হবে
আবহাওয়ার আর্দ্রতা সম্পর্কে আমরা কম-বেশি সবাই জানি। পৃথিবীর চারভাগের তিন ভাগই জল। জলাশয় থেকে প্রতিনিয়ত পানি বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমন্ডলে মিশে যাচ্ছে। ফলে বায়ুমণ্ডল ভেজা থাকে তথা আর্দ্র থাকে। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে বায়ুমণ্ডলের জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বিভিন্ন হয়। এটা নির্ভর করে স্থান ও আবহাওয়ার উপর। একই স্থানে বিভিন্ন ঋতু ও সময়ে বায়ুমন্ডলে অবস্থিত জলীয় বাষ্পের তারতম্য হয়। বর্ষাকালে বায়ুমন্ডলের জলীয় বাষ্প বেশি থাকে এবং শীতকালে কম থাকে।
আর্দ্রতাঃ কোন স্থানে বায়ুতে কতটুকু জলীয় বাষ্প আছে অর্থাৎ বায়ু কতখানি শুষ্ক বা ভেজা আর্দ্রতা দিয়ে তাই নির্দেশ করে। আবার যে তাপমাত্রায় একটি নির্দিষ্ট আয়তনে বায়ুতে উপস্থিত জলীয় বাষ্প দ্বারা সম্পৃক্ত হয় তাই ঐ বায়ুর শিশিরাংক।
আসলে আদ্রতা মাপক যন্ত্র দিয়ে আবহাওয়ার পূর্বভাস জানা যায়। এই যন্ত্রকে হাইগ্রোমিটার বলে। হাইগ্রোমিটারের দুটি থার্মোমিটারের পাঠের পার্থক্য যদি-
- কম হয় তাহলে আবহাওয়া আর্দ্র।
- বেশি হলে আবহাওয়া শুষ্ক হবে।
- ধীরে ধীরে কমতে থাকলে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
- হঠাৎ কমে গেলে ঝড়ের সম্ভাবনা রয়েছে(alert-success)
তখনই ঝড় হবে যখন থার্মোমিটার পাঠে পার্থক্য হঠাৎ করে কমে গেলে।
বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানে রিমাল নামের সাইক্লোনটি। তোমাদের মনে কি প্রশ্ন আসছে না, ঘূর্ণিঝড়ের এই অদ্ভুত নামগুলো কে রাখে? আর সাইক্লোন, হারিকেন আর টাইফুন এই তিন রকম ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে শুধু সাইক্লোনই কেন আমাদের দেশে আঘাত হানে? কিংবা এসব ঘূর্ণিঝড়ের পিছনের বিজ্ঞান কী বলে?
যদি এই প্রশ্নগুলো তোমাদের নিউরনে ছোটাছুটি করে, তাহলে তোমাদের অভিনন্দন। আজকে আমরা ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।
প্রথমেই আসি নামকরণ প্রসঙ্গে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার আঞ্চলিক কমিটিগুলো সে অঞ্চলের ঝড়গুলোর নামকরণ করে থাকে। যেমনঃ বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর উপকূলীয় অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক করে এখানকার ১৩ টি দেশ। বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইয়েমেন। দেশগুলোর ইংরেজি নামের প্রথম বর্ণের পর্যায়ক্রমে নামকরনের সুযোগ দেওয়া হয়।
এবার আমরা সাইক্লোন, হারিকেন এবং টাইফুন ঘূর্ণিঝড়ের এই তিনটি প্রকারভেদ সম্পর্কে জানব।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণে এদের বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। বিভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানে এদের বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। ভারত ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় সাইক্লোন। উত্তর আটলান্টিক, উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরে যে ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি তাকে বলা হয় হারিকেন। আর উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের ঘূর্ণিঝড়টিকে বলা হয় টাইফুন। নিচের ছবিটি দেখলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে।
এখন আমরা জানব সাগরের বুকে কিভাবে ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি হয়। ঘূণিঝড় সৃষ্টির পূর্বশর্ত দুটি। তাপমাত্রা কমপক্ষে ২৬.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস হতে হবে। আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উপর দিয়ে হতে হবে বায়ুপ্রবাহ। এই উচ্চ তাপমাত্রায় বাষ্পীভবন বেড়ে যায়। ফলে বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠে থাকা বায়ুকণাগুলো উত্তপ্ত হয়ে উপরে উঠে যায়। এই ফাঁকা জায়গায় সৃষ্টি হয় নিম্নচাপ, আর তাই আশেপাশের জায়গা থেকে এখানে বাতাস ও মেঘ ছুটে আসে। উপরে উঠতে থাকা বায়ুকণাগুলো প্রায় ১০ কিলোমিটার উপরে গিয়ে ঠান্ডা হয় এবং ঘনীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হয়।ক্রমশ আরো বাতাস উপরে গিয়ে তাপ ছেড়ে দিতে থাকে আর মেঘের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এই ছেড়ে দেয়া তাপই মূলত ঘূর্ণিঝড়টিকে শক্তি জোগায়। আশপাশ থেকে ধেয়ে আসা বাতাস কিন্তু সোজাপথে আসে না। এটি বেঁকে যায় পৃথিবীর ঘূর্ণনের প্রভাবে। একে বলে কোরিওলিস প্রভাব। এর কারণে উত্তর গোলার্ধে বাতাস বেঁকে যায় ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে আর দক্ষিণ গোলার্ধে বেঁকে যায় ঘড়ির কাঁটার দিকে। ফলে ঘূর্ণন শুরু হয়।
ঘূর্ণনের কেন্দ্রকে বলা হয় চোখ (eye)। কেন্দ্রে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব সবচেয়ে কম। কেন্দ্র থেকে একটু দূরের অঞ্চলটিকে বলা হয়, চোখের দেয়াল (eye wall)। এখানে বাতাসের গতি সবচাইতে বেশি। আর তাই ঘূর্ণিঝড়ের এই অংশটি সবচেয়ে বেশি ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। কেন্দ্র থেকে আরেকটু দূরে থাকে বৃষ্টিকুণ্ডলী (rain band) অঞ্চল। এই অঞ্চলটি তেমন বিধ্বংসী না, তবে বৃষ্টিপাত হয়। তাই এই নামকরণ। ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ নির্ভর করে বৈশ্বিক বায়ুপ্রবাহের ওপর। এই কারণেই মাঝে মাঝে ঘূর্ণিঝড়ের দিক পরিবর্তন হতে দেখা যায়। যেমনঃ এবার মোখা দিক পরিবর্তন করে মায়ানমারের দিকে চলে গেছে। যার ফলে পূর্বাভাসের তুলনায় কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশে। ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত হওয়া সবচেয়ে প্রলয়ংকরী ৩৬ টি ঘূর্ণিঝড়ের ২৬ টিই হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। একটু ভেবে দেখো তো অন্য স্থানের তুলনায় বঙ্গোপসাগর উপকূল কেন এত ঘূর্ণিঝড়প্রবণ?
ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর হয় অবতল আকৃতির উপসাগরে। কেননা ঝড়ের সময় তীব্র বাতাস সাগরের ফুঁসে ওঠা পানিকে অবতল আকৃতির উপকূলের দিকে ঠেলতে থাকে। আর বঙ্গোপসাগর উপকূল ঠিক এমনটাই। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের গভীরতা কম, তাই উপকূলের দিকে ধেয়ে আসা পানিকে সে ধারণ করতে পারে না। পানি প্রবেশ করে হলে, সৃষ্টি হয় জলোচ্ছ্বাস। আবার বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক অবস্থান বিষুব রেখার কাছাকাছি। তাই এখানে সমুদ্রের তাপমাত্রা বেশি। ফলে বাষ্পায়ন বেশি হয়, বেড়ে যায় ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা। ১৯৭০ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক ভোলা সাইক্লোনটিও এই উপকূলেই আঘাত হেনেছিল।(full-width)