ধরুন আপনি একজন নাবিক, বিশাল সমুদ্রযাত্রায় বের হয়েছেন। পাড়ি দিতে হবে আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগর। কিন্তু সামনে এক বিশাল বাধা- একটা পুরো মহাদেশ! হাজার হাজার কিলোমিটার ঘুরে ভয়ঙ্কর কেপ হর্ন পার হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

কেনই বা পানামাতেই তৈরি করা হলো?
ঝড়, উঁচু ঢেউ আর প্রাণঘাতী জলযাত্রার ভয় তাড়া করছে আপনাকে। কিন্তু যদি জাদুর মতো সরু একটা জলপথ দিয়ে মহাদেশের এক পাশ থেকে আরেক পাশে সহজেই পৌঁছে যেতে পারতে? মুহূর্তের মধ্যে বেঁচে যেত প্রায় ১৩,০০০ কিলোমিটার বাড়তি পথ।
এটা কি সম্ভব?
মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে! প্রকৃতির বিশাল বাধা পেরিয়ে তৈরি হয়েছে পানামা খাল, যা বদলে দিয়েছে বিশ্বের বাণিজ্য ও সমুদ্রপথের ইতিহাস। কিন্তু কীভাবে তৈরি হলো এই বিস্ময়?
পানামা খাল কেন তৈরি করা হয়েছিল?

এটা বুঝতে হলে এর অবস্থানটা ভালোভাবে জানতে হবে। পানামা হলো একটি দেশ। এর একদিকে প্রশান্ত মহাসাগর (Pacific Ocean), অন্যদিকে আটলান্টিক মহাসাগর। এ সরু ভূখণ্ডটি দুটি মহাসাগরকে আলাদা করে রেখেছে। আবার উত্তর আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা এর মাধ্যমেই একে অপরের সাথে যুক্ত।
বাণিজ্যিক কাজের জন্য অনেক আগে থেকেই মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাতায়াত করে। আর সেটা হয় মূলত সমুদ্রপথে। ধরুন, যদি চীনের সাংহাই থেকে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে যেতে হয়, পানামা খাল তৈরির আগে যেতে হতো দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরে। বিশাল পথ। মাঝখানে যদি পানামার মধ্য দিয়ে একটা খাল থাকে, তাহলে শর্টকাট পথে পাড়ি দেয়া যাবে। এতে সময়, জ্বালানি সবই কম লাগবে।
সেটা অনেক লাভজনক না?
আবার যে দেশ খালটা তৈরি করতে পারবে, বিশ্বজুড়ে ব্যবসার উপর তার বিশেষ প্রভাব থাকবে। পাশাপাশি আমেরিকার দিকে দেখ। পানামার মধ্য দিয়ে খাল থাকলে তারা এক মহাসাগর থেকে অন্য মহাসাগরে তাদের যুদ্ধজাহাজ সরাসরি নিয়ে যেতে পারবে। তা না হলে বিশাল পথ ঘুরে সেটা করতে হতো। কাজেই সামরিক ক্ষেত্রেও এই থালটা থাকা ভানেক সুবিধাজনক। পানামা খালের গুরুত্বটা মানুষ জানতে পেরেছে অনেক আগেই, সেই ষোল শতকের দিকে। তবে এটা তৈরি হয়েছে ১৯১৪ সালে।
বিষয়টা এমন না যে মানুষ এর পূর্বে খাল খনন করতে জানত না। সুয়েজ খাল, পানামা খালের চেয়ে বড় এবং সুয়েজ খাল তৈরি করা হয়েছে পানামা খাল তৈরির পূর্বে। কিন্তু পানামা খাল তৈরি করতে না পারার পেছনে একটা বড় কারণ ছিল পানামার প্রতিকূল পরিবেশ। পাহাড়, বন-জঙ্গল, নদ-নদী নিয়ে গঠিত পানামাতে তখনকার প্রযুক্তি দিয়ে খাল খনন করা একপ্রকার অসম্ভবই ছিল।
সর্বপ্রথম ১৯৮১ সালে সেখানে খাল খননের পদক্ষেপ নেন Ferdinand, viscount de Lesseps. তিনি ছিলেন একজন ফরাসি কূটনীতিক। মিশরে সুয়েজ খাল খননের দায়িত্বেও তিনিই ছিলেন। তার আইডিয়া ছিল পানামার সবচেয়ে সরু স্থানে মাটি খুঁড়ে সমুদ্রের লেভেলের খাল খনন করা। যাতে দুই সমুদ্র মিলিত হয়ে যায়। সাধারণত খাল এভাবেই খনন করা হয়।
সব জাহাজ কি পানামা খাল দিয়ে যেতে পারবে?
একটা জাহাজ যদি খালের চেয়ে বেশি প্রশস্ত হয়, তাহলে সেটা সেখান দিয়ে কীভাবে যাবে? এর জন্য সর্বোচ্চ একটা লিমিট ঠিক করে দেয়া আছে। এটাকে বলা হয় Panamax। নির্ধারিত এই লিমিটের চেয়ে বড় জাহাজ সেখান দিয়ে অতিক্রম করতে পারে না। এজন্য কোন জাহাজ এই খাল দিয়ে যেতে হলে জাহাজটা তৈরির সময়েই এ বিষয়টা মাথায় রাখতে হয়। এই Lock-এর গেটগুলো কীভাবে বানানো হলো যে, গেটের দুপাশে পানির লেভেল ভিন্ন হলেও পানি এক পাশ থেকে অন্য পাশে যেতে পারে না?

মজার বিষয় হলো গেটের ডিজাইন আইডিয়াটা এসেছে লিউনার্দো দ্যা ভিঞ্চির কাছ থেকে। গেটের ছবিটা দেখ। পানির প্রবাহের দিকে ‘V’ আকৃতির। এতে পানির ধাক্কাতেই দরজাদুটো একে অপরকে চাপ দিবে এবং দরজাটা বন্ধ থাকবে। পানি যেদিক থেকে আসছে, সেদিকে পানির উচ্চতা যত বেশি থাকবে ধাক্কা তত বেশি হবে।
ফলে দরজাদুটো আরো শক্তভাবে লেগে থাকবে। কিন্তু যদি উভয়পাশে পানির লেভেল সমান করা হয় এবং স্রোত না থাকে তাহলে সহজেই সেটা খুলে ফেলা যায়। পানামা এমন একটি অঞ্চল যেখানে খাল কেটে জাহাজ চালানো একসময় মানুষের কল্পনারও বাইরে ছিল। এই Lock System তো অনেক দূরের কথা।