গ্যালিলিও গ্যালিলি – জ্যোর্তিবিদ্যায় অসামান্য অবদান

Date:

শেয়ারঃ

জিওর্দানো ব্রুনোর প্রাণদণ্ডের বছরে গ্যালিলিও গ্যালিলি ছত্রিশে পা রাখেন। কোপার্নিকীয় দর্শন ঠিক বলে মানতেন তিনি, কিন্তু ব্রুনোর ভয়ঙ্কর পরিণামে এত বিচলিত হন যে প্রত্যক্ষভাবে সে দর্শন সমর্থন করার ঝুঁকি নিতে চাননি।


সংগৃহীত

ঠিক এ সময়ে ঘটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা: দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কৃত হলো। নতুন যন্ত্রটি দিয়ে প্রথম তারা দেখেন গ্যালিলিও। ইতালির এই জ্যোতির্বিদ আকাশে যা দেখলেন, তাতে মোক্ষম বোঝা গেল যে কোপার্নিকীয় দর্শন সত্য। চাঁদে গ্যালিলিও দেখলেন পাহাড়; আর দেখা গেল, চাঁদ বেশ বড় একটা জগৎ, আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে অনেক মিল আছে। চাঁদের মতোই একটা কাস্তের রূপে শুক্র গ্রহকে দেখেন গ্যালিলিও, গ্রহটি আকাশে একটি উজ্জ্বল বিন্দু মাত্র নয়। সবচেয়ে কৌতূহলের বিষয় হলো, বৃহস্পতির পর্যবেক্ষণ, যেটা গ্যালিলিও শুরু করেন ১৬১০ সালের ৭ জানুয়ারি। তিনি দেখলেন, বৃহস্পতি আলোর একটি ক্ষুদ্র কণামাত্র নয়, বেশ বড় একটা বৃত্ত। বৃত্তের কাছাকাছি তিনটি ছোট দাগ। ১৩ জানুয়ারি আরেকটি দাগ চোখে পড়ল গ্যালিলিওর। চাঁদের উপরিভাগে তারা দেখত প্রকাণ্ড কালো কালো ছোপ, যেগুলোকে গ্যালিলিও ভুল করে ভাবতেন সমুদ্র ও মহাসাগর; দীর্ঘ পর্বতমালা; ছায়ার দীর্ঘতা বিচার করে তাদের উচ্চতা হিসাব করতে শেখেন গ্যালিলিও। চাঁদ আকাশমণ্ডলে আবদ্ধ একটি রূপালি চাকতি, পৃথিবীকে আলো জোগানোর জন্য তার সৃষ্টি—এ কথা শুনলে তখনি লোকে হাসত। অদ্ভুত এ সব আবিষ্কারের পর গ্যালিলিও আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তখনো ক্যাথলিক চার্চ প্রকাশ্যভাবে কোপার্নিকাসের দর্শনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও একটি বই লিখলেন, যার নামটি চমৎকার—সিডেরিউস নানসিয়াস; অর্থাৎ তারাদের অগ্রদূত। বইতে কোপার্নিকীয় দর্শনের স্বপক্ষে লেখেন গ্যালিলিও, কিন্তু লেখেন মহা সাবধানে। চার্চ-পিতারা চিন্তিত হলেন: ব্রুনোকে হত্যা করা হয়েছে, তবু কোপার্নিকাসের মতামত লোপ পায়নি, বরং সে দর্শনের একজন নতুন সমর্থক দেখা দিয়েছে লোকের মধ্যে মতবাদ ছড়ানোর জন্য। আর এই সমর্থক এবং সহজ-লিখিয়ে এমন এক বিদ্বান ব্যক্তি, যাঁর নাম সারা ইউরোপ জানে।


ক্যাথলিক চার্চের প্রধান, রোমের পোপ ১৬১৬ সালে একটি ডিক্রি জারি করলেন। তাতে বলা হলো, কোপার্নিকীয় দর্শন সমর্থন করে বই ছাপালে গুরু দণ্ড দেওয়া হবে। এ ধরনের বই এমনকি কাছে রাখলেও অপরাধ বলে মানা হবে। কোপার্নিকাসের মতামতের প্রতি চার্চের ঘৃণা এত বিপুল যে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত এর সমর্থন করে বই ছাপানো নিষিদ্ধ ছিল। তারপর চার্চ-পিতারা স্বয়ং গ্যালিলিওকে আক্রমণ করলেন। ১৬৩২ সালে দুই বিশ্বদর্শন বিষয়ে কথোপকথন নামে একটি বইতে তিনি কোপার্নিকীয় দর্শন সমর্থন করেন। অনেক কষ্টে বইটা তিনি ছাপাতে পারলেন। মুদ্রাকররা তাঁর অর্ডার প্রত্যাখ্যান করে—কোপার্নিকীয় বিধর্ম প্রচারের অভিযোগে নির্যাতিত হওয়ার ভয়ে। যাহোক, তবু বইটি ছাপা হয়ে বেরোল। চার্চ-পিতারা রেগে আগুন।


গ্যালিলিওর বই বিতরণ করা নিষিদ্ধ হলো; বৃদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে হুকুম করা হলো রোমে যেতে, সেখানে তাঁর বিচার করবেন স্বয়ং পোপ। মৃত্যুর ভয় দেখানো হলো তাঁকে; জিজ্ঞাসাবাদ চলল নির্যাতনকক্ষে, সেখানে চোখের সামনে সেই ভয়াবহ যন্ত্রগুলো—চামড়ার ফানেল, যাতে করে পেটে বিপুল পরিমাণে জল ঢোকানো হয়, পা দুমড়ে দেওয়ার লোহার বুট, হাড় ভাঙার সাঁড়াশি। জীর্ণ বৃদ্ধ এ সব হুমকি সইতে পারলেন না, নিজের মতামত প্রত্যাহার করলেন। ২২ জুন বিরাট জনতার সামনে চার্চে নতজানু হয়ে বসে তিনি প্রকাশ্যে তাঁর অনুশোচনা ব্যক্ত করলেন। এমনকি তখনো চার্চ তাঁকে হাতের মুঠোছাড়া করল না। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ইনকুইজিশনের বন্দী হয়ে রইলেন। পৃথিবীর গতি সম্বন্ধে কারো সঙ্গে আলোচনা করা তাঁর বারণ। তবু গোপনে একটি বই লেখেন গ্যালিলিও, যাতে পৃথিবী ও জ্যোতিষ্কদের বিষয়ে সত্য কথাটি তিনি স্পষ্টভাবে বলেন। নির্যাতন, যন্ত্রণা বা প্রাণদণ্ড, কিছুতেই নতুন মতামতের প্রসার রোখা গেল না। বিজ্ঞানের বীর ও শহীদদের মহতী কাজ সার্থক হতে লাগল।

mehrab360
mehrab360https://www.mehrab360.com
হোসাইন হাওলাদার, mehrab360.com এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য, বিশ্লেষণ ও হালনাগাদ কনটেন্ট নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করে। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে জটিল প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো সহজভাবে তুলে ধরা। বিশ্বের প্রযুক্তি জগতের সর্বশেষ আপডেট, রিভিউ ও ব্যাখ্যামূলক কনটেন্ট পড়তে পারবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

বিজ্ঞাপনspot_img

এই সম্পর্কে আরো পড়ুন

প্রথম কৃষ্ণগহ্বরের রঙিন ছবি!

রঙ একটি পছন্দনীয় জিনিস। পদার্থবিজ্ঞানে ভাষায় আলোর রঙ তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য দ্বারা নির্ধারিত হয়। তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত বেশি বা কম...

চীন-রাশিয়া চাঁদে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে!

২০৩৫ সালের মধ্যে চাঁদে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের একসাথে পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে চীন ও রাশিয়া। চলতি মাসের শুরুর দিকে...

কৃষ্ণগহ্বর আসলে কতটা ভয়াবহ!

কৃষ্ণগহ্বর এমন এক জায়গা যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এতটাই শক্তিশালী যে, কোনও কিছুই এমনকি আলোও পড়তে পারে না। কৃষ্ণগহ্বরের...

মহাবিশ্ব অতিক্রম করার সময় কি আলো শক্তি হারায়?

আলো হলো তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ। একটি বৈদ্যুতিক তরঙ্গ এবং একটি চৌম্বক তরঙ্গ একত্রিত হয়ে স্থান-কালের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ...