আমরা বর্তমানে যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছি, শুরুতে তা এমন ছিল না। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি উন্নয়নের ফলে মোবাইল ফোন বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। উন্নয়নের এক একটি পর্যায় বা ধাপকে মোবাইল ফোনের প্রজন্ম নামের অভিহিত করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ের এই মোবাইল ফোনের কার্যক্ষমতা ছিল খুবই কম; দুর্বল নেটওয়ার্কের দরুন সীমিত এলাকাভিত্তিক ব্যবহার হতো। 1940 সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রথম মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরু করে। এশিয়ার সর্ববৃহৎ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি জাপানের NTTC (Nippon Telegraph and Telephone Corporation) বাণিজ্যিকভাবে মোবাইল ফোন বা সেলুলার ফোন উৎপাদন শুরু করে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন থেকে বর্তমান পর্যন্ত মোবাইল ফোন উন্নতির সময়কালকে পাঁচটি প্রজন্মে ভাগ করা হয়েছে।

শেয়ার
টেলিফোন প্রযুক্তিতে প্রযুক্তির উন্নতির ফলে মোবাইল বিপ্লব সাধিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সর্বপ্রথম Motorola Dyna TAC নামে হ্যান্ড মোবাইল সেট চালু করে। একই সময়ে সেখানে AMPS (Advanced Mobile Phone System) স্ট্যান্ডার্ড বাণিজ্যিকভাবে প্রথম প্রজন্মের মোবাইল ফোন চালু করা হয়। AMPS অ্যানালগ সিস্টেম ব্যবহার করে যোগাযোগ স্থাপন করত। এর পাশাপাশি ব্রিটেনে TACS (টোটাল অ্যাকসেস কমিউনিকেশন সিস্টেম) সব টেলিফোনে সেমিকন্ডাক্টর ও মাইক্রোপ্রসেসর এবং কম ব্যান্ডের সিগন্যাল ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করা হতো। তাই এতে যেকোনো ধরনের মোবাইল অপারেটর কোম্পানির নেটওয়ার্ক ব্যবহারের সুবিধা ছিল না। এছাড়া রোমিং ব্যবস্থা সীমিত ছিল।
অ্যানালগ ট্রান্সমিশনের পরিবর্তে ডিজিটাল ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে দ্বিতীয় প্রজন্মের মোবাইল ফোন চালু হয়। তাই Second Generation-2G কে ডিজিটাল সেলুলার নেটওয়ার্ক বলা হয়। এ সময়ের মোবাইল ফোনের টেকনোলজির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো GSM (Global System for Mobile Communication) এবং CDMA (Code Division Multiple Access) সুবিধা।
এসব সুবিধা নিয়ে এবং ভয়েসকে নয়েজমুক্ত করার মাধ্যমে দ্বিতীয় প্রজন্মের মোবাইল ফোনের সূচনা হয়। এজন্য সেকেন্ড জেনারেশন মোবাইলকে জিএসএম বা সিডিএমএ স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়। সময়ের পরিক্রমায় মোবাইল হ্যান্ডসেটের আকৃতি ও ওজন উল্লেখযোগ্য হারে কমতে থাকে। ক্রমান্বয়ে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রি-পেইড পদ্ধতি, এসএমএস, এমএমএস ও ইন্টারনেট সেবা চালু হয়। এ সময়ে আন্তর্জাতিক রোমিং সিস্টেম চালু হয়।
জাপানের DoCoMo কোম্পানি পরীক্ষামূলকভাবে তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল ফোন চালু করে। দ্বিতীয় হতে তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল ফোনের প্রযুক্তিগত পার্থক্য হলো সার্কিট সুইচিং ডেটা ট্রান্সমিশনের পরিবর্তে প্যাকেট সুইচিং ডেটা ট্রান্সমিশনের ব্যবহার। সার্কিট সুইচিং পদ্ধতিতে নেটওয়ার্কিং রিসোর্স বা ব্যান্ডউইথ বিভিন্ন অংশ বা পার্টে বিভক্ত হয়ে একটি সুনির্দিষ্ট পথে গন্তব্যে পৌঁছে, যার ফলে এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা কম। প্যাকেট সুইচিং পদ্ধতিতে নেটওয়ার্কিং রিসোর্স বা ব্যান্ডউইথ বিভিন্ন প্যাকেটে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথে গন্তব্যে পৌঁছে এবং এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ়। এতে অবশ্য উভয় সুইচিং পদ্ধতি চলে। পূর্বের তুলনায় উচ্চ ব্যান্ডের সিগন্যাল ফ্রিকোয়েন্সির ব্যবহার শুরু হয় (ডেটা ট্রান্সফার রেট 2 Mbps- এর বেশি)। ভিডিও কল, ইন্টারনেট, ই-কমার্স, মোবাইল ব্যাংকিং, FOMA (Freedom of Multimedia access) ইত্যাদি সুবিধা নিয়ে থ্রি-জি মোবাইল ফোন চালু হয়।
চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল ফোনের প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য হলো সার্কিট সুইচিং বা প্যাকেট সুইচিং ডেটা ট্রান্সমিশনের পরিবর্তে ইন্টারনেট প্রটোকলভিত্তিক নেটওয়ার্কের ব্যবহার। ফলে LAN, WAN, VoIP, Internet প্রভৃতি সিস্টেমে প্যাকেট সুইচিংয়ের পরিবর্তে প্রটোকলভিত্তিক ভয়েস ডেটা ট্রান্সফার সম্ভব হচ্ছে। দ্রুত চলনশীল ডিভাইসের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির ডেটা ট্রান্সফার রেট 100 Mbps, ত্রিমাত্রিক এবং স্থির ডিভাইসের ক্ষেত্রে 1 Gbps পর্যন্ত হতে পারে। এটি LTE (Long Term Evolution) স্ট্যান্ডার্ডে কাজ করে থাকে। মোবাইল ওয়েব অ্যাকসেস, আই.পি টেলিফোনি, গেমিং সার্ভিসেস, হাই ডেফিনিশন মোবাইল টিভি, ভিডিও কনফারেন্সিং, থ্রিডি টিভি ইত্যাদি ক্ষেত্রে 4G প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়। এর গতি 3G’র চেয়ে 50 গুণ বেশি।
5G বা পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক সিস্টেম মোবাইল ফোনের মধ্যে অত্যাধুনিক ও সর্বশেষ সংস্করণ। এ ধরনের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়্যারলেস ওয়েব (World Wide Wireless Web) বা সংক্ষেপে WWWW নামে পরিচিত। এ ধরনের মোবাইল ফোনের স্ট্যান্ডার্ডগুলোর মধ্যে 5G NR (New Radio), RAT (Radio Access Technology). MIMO (Multiple Input and multiple output) অন্যতম। এই প্রজন্মের মোবাইল ফোনের পারফর্ম্যান্স 4G’র তুলনায় অনেকগুণ বেশি এবং অনেক দ্রুতগতিতে ডেটা ট্রান্সফার করতে সক্ষম। এর মাধ্যমে 4K টিভি বা ভিডিও উপভোগ করা যায়। যুগের সাথে আধুনিক জীবন ব্যবস্থার উৎকর্ষতার চাহিদার প্রতি লক্ষ রেখে মোবাইল যোগাযোগ ব্যবস্থার চরম এবং সর্বোত্তম ব্যবহারের বিষয় বিবেচনা করে বিশ্বসেরা মোবাইল ফোন কোম্পানি এবং অন্যান্য বেশ কটি প্রতিষ্ঠান এর উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে 5G প্রযুক্তির মোবাইল ফোন একটি বাস্তবতা। পৃথিবীর অনেক দেশেই এটি চালু হয়েছে। আমাদের দেশেও 5G চালু হতে যাচ্ছে।