বঙ্গাব্দ
© Mehrab360

মোবাইল ফোন চার্জ হওয়ার সময় গরম হয়ে ওঠে কেন?

© Mehrab360
বর্তমান যুগে মোবাইল ফোন মানুষের নিত্যসঙ্গী এক প্রযুক্তিপণ্য। দিন যতই যাচ্ছে, এর ব্যবহার ততই বাড়ছে। ফোনে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহার, গেম খেলা, ভিডিও দেখা, ছবি তোলা, অনলাইন ক্লাস বা মিটিং করা – সব মিলিয়ে মোবাইল এখন এক বহুমুখী যন্ত্র। কিন্তু ফোন ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে একটি সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা প্রায়ই দেখা যায় – চার্জ দেওয়ার সময় মোবাইল গরম হয়ে ওঠা। অনেকেই এই সমস্যাকে গুরুত্ব দেন না, আবার অনেকে এটাকে বিপজ্জনক বলে মনে করেন। তাহলে আসলে কেন মোবাইল ফোন চার্জের সময় গরম হয়ে ওঠে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের জানতে হবে মোবাইল চার্জিং প্রসেস, ব্যাটারির গঠন, বিদ্যুৎ প্রবাহ, তাপ উৎপাদন, সফটওয়্যার কার্যক্রম এবং অন্যান্য যান্ত্রিক উপাদানগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে।

সংগৃহীত

প্রথমেই বলা যায়, মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়ার সময় ব্যাটারির মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। সাধারণত লিথিয়াম-আয়ন (Lithium-ion) বা লিথিয়াম-পলিমার (Lithium-polymer) ব্যাটারি মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত হয়। এই ব্যাটারিগুলো চার্জিং এবং ডিসচার্জিং প্রক্রিয়ায় তাপ তৈরি করে থাকে। যখন ফোনে চার্জ দেওয়া হয়, তখন চার্জার থেকে বিদ্যুৎ ব্যাটারির মধ্যে চলে আসে এবং ব্যাটারির পজিটিভ এবং নেগেটিভ ইলেকট্রোডের মধ্যে আয়ন স্থানান্তর হয়। এই রসায়ন প্রক্রিয়ায় ইলেকট্রন ও আয়নের গতি এবং প্রতিক্রিয়ার ফলে একটি তাপমাত্রা উৎপন্ন হয়। যদিও এই তাপমাত্রা সাধারণত খুব বেশি নয়, কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট অবস্থায় তা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং ফোনের গরম হয়ে যাওয়ার অনুভুতি তৈরি করে।

একটি অন্যতম কারণ হলো – ফাস্ট চার্জিং প্রযুক্তি। বর্তমানের অনেক ফোনে কুইক চার্জ, VOOC, Warp Charge, SuperCharge ইত্যাদি ফিচার যুক্ত করা হয়েছে যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যাটারি চার্জ হয়ে যায়। এই প্রযুক্তিতে উচ্চ ভোল্টেজ এবং বেশি অ্যাম্পিয়ার ব্যবহার করা হয়, ফলে ব্যাটারিতে বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রবেশ করে এবং সেই সঙ্গে বাড়ে তাপ উৎপাদন। এই বাড়তি তাপ যদি পর্যাপ্তভাবে ডিসিপেট (বিচ্ছুরিত) না হয়, তবে ফোনের গঠন অনুযায়ী সেটি বাইরে থেকে গরম বলে মনে হয়।

আরেকটি কারণ হলো, চার্জ দেওয়ার সময় একসঙ্গে ফোন ব্যবহার করা। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ ইউটিউবে ভিডিও দেখছেন বা গেম খেলছেন, আবার চার্জেও দিয়েছেন। এতে করে ফোনের প্রসেসর, স্ক্রিন এবং ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যাপ একসঙ্গে কাজ করে। ফলে প্রসেসরের লোড বাড়ে এবং তা থেকে অতিরিক্ত তাপ তৈরি হয়। একই সময়ে ব্যাটারির মধ্যেও চার্জিং প্রক্রিয়া চলায় তাপমাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। এর ফলে ফোন দ্রুত গরম হয়ে যায়, এমনকি মাঝে মাঝে হ্যাং হয়ে যাওয়া বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে।

নিম্নমানের চার্জার বা ক্যাবল ব্যবহারের বিষয়টিও এখানে উল্লেখযোগ্য। অনেক সময় আমরা যে চার্জার বা ডাটা কেবল ব্যবহার করি, তা হয়তো মোবাইল প্রস্তুতকারক কোম্পানির নয়। এমনকি সস্তা ও নকল চার্জার ব্যবহারের সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিয়মিত থাকে এবং এতে করে অতিরিক্ত গরম হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এছাড়াও চার্জারটির ভোল্টেজ ও অ্যাম্পিয়ার যদি ফোনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তবে তা ফোনের ভেতরে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে এবং ব্যাটারির আয়ু হ্রাসের পাশাপাশি অতিরিক্ত তাপ উৎপাদনের কারণ হয়।

অনেকে হয়তো খেয়াল করেননি যে, পরিবেশের তাপমাত্রাও ফোন গরম হয়ে ওঠার একটি বড় কারণ। যেমন ধরুন, যদি কেউ রোদে বা খুব গরম জায়গায় ফোন রেখে চার্জ দেয়, তাহলে ফোনের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাংশের উপর বাইরের তাপও প্রভাব ফেলে। তাছাড়া, ধাতব বা কাচের ব্যাক কভারের ফোনে তাপ বেশি অনুভূত হয় কারণ এই উপাদানগুলো তাপ পরিবাহিত করতে পারে, যা আমাদের হাতে গরম লাগার অনুভূতি তৈরি করে।

ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যাপস বা সফটওয়্যারের বাগ অনেক সময় ফোনকে গরম করে তোলে। বিশেষ করে যদি ফোনে অনেক বেশি অ্যাপস ইনস্টল করা থাকে এবং সেগুলোর মধ্যে কিছু অ্যাপ ব্যাকগ্রাউন্ডে নিয়মিতভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার বা প্রসেসর ব্যবহার করে, তবে সেগুলোর কারণে ফোনের CPU বেশি ব্যস্ত থাকে। চার্জ দেওয়ার সময় এমন অ্যাপস সক্রিয় থাকলে তাপ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া সফটওয়্যারের কোনো ত্রুটি বা অপ্টিমাইজেশনের অভাব থাকলেও ফোন চার্জিংয়ের সময় অতিরিক্ত উত্তাপ দেখা দেয়।
হার্ডওয়্যার সমস্যা-কেও এই প্রেক্ষাপটে অগ্রাহ্য করা যাবে না। যেমন ধরুন, ফোনের মাদারবোর্ড, চার্জিং আইসি বা পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট চিপে কোনো সমস্যা থাকলে চার্জিং প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না। এর ফলে বিদ্যুৎ প্রবাহে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়, যা ব্যাটারি ও ফোনের অন্যান্য অংশকে অস্বাভাবিকভাবে উত্তপ্ত করতে পারে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো – ব্যাটারির স্বাস্থ্য। পুরনো ব্যাটারি বা বহুবার চার্জ-ডিসচার্জ হওয়া ব্যাটারিগুলোতে অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ (internal resistance) বৃদ্ধি পায়। ফলে, যখন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, তখন বেশি পরিমাণে তাপ উৎপন্ন হয়। অতিরিক্ত তাপ ব্যাটারির কার্যকারিতা হ্রাস করে এবং ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে। দীর্ঘদিনের পুরনো ফোনে এমন ঘটনা বেশি ঘটে। তাই নিয়মিত ব্যাটারির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি।

কেস বা কাভার ব্যবহার করাও ফোন গরম হওয়ার একটি কারণ হতে পারে। বিশেষ করে পুরু বা প্লাস্টিকের কভার ফোনের তাপ বাইরে বের হতে দেয় না। ফলে, চার্জিং চলাকালীন উৎপন্ন হওয়া তাপ ফোনের ভেতর আটকে যায় এবং ফোন গরম হয়ে ওঠে। কিছু কভার এমনকি চার্জিং পোর্টের আশপাশে বাতাস চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে, যা তাপ নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করে।

এই সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বোঝা যায় যে, ফোন চার্জ দেওয়ার সময় গরম হয়ে ওঠার ঘটনা একটি স্বাভাবিক পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের প্রতিক্রিয়ার অংশ হলেও, এটি কোনো কোনো পরিস্থিতিতে উদ্বেগজনক হয়ে উঠতে পারে। সাধারণত হালকা গরম হওয়া ফোনের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। তবে যদি ফোন অতিরিক্ত গরম হয়, এতটাই যে ছোঁয়া যায় না, বা ফোন নিজেই বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সেটি অবহেলা না করে সমাধানের পথে যাওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে কিছু প্রতিকার গ্রহণ করা যেতে পারে – যেমন, মূল কোম্পানির চার্জার ব্যবহার করা, চার্জ দেওয়ার সময় ফোন ব্যবহার না করা, কভার খুলে চার্জ দেওয়া, ফোনকে ঠান্ডা জায়গায় রাখা, অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ বন্ধ রাখা এবং সময়মতো সফটওয়্যার আপডেট করা।

মোবাইল ফোনের চার্জিংয়ের সময় গরম হয়ে ওঠা একটি বহুমাত্রিক বিষয়, যার পেছনে রয়েছে বিদ্যুৎ প্রবাহ, রসায়ন, যন্ত্রাংশের কাজ এবং ব্যবহারকারীর অভ্যাসের ভূমিকা। এই বিষয়ে সচেতনতা এবং কিছু সাবধানতা অবলম্বন করে খুব সহজেই ফোনের অতিরিক্ত গরম হওয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব। প্রযুক্তি যতই উন্নত হচ্ছে, ততই ফোন নির্মাতারা তাপ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তিতে জোর দিচ্ছে। তবুও ব্যবহারকারীর দিক থেকে যত্নবান হওয়া খুবই প্রয়োজন, যাতে প্রযুক্তি আমাদের উপকারে আসে, ক্ষতির কারণ না হয়।
{fullWidth}
© Mehrab360